🟩 ইমাম বুখারী (রহ.) – হাদীসশাস্ত্রের অমর বাতিঘর

✦ ইমাম মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল আল-বুখারী (৮১০–৮৭০ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন ইসলামী হাদীসশাস্ত্রের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম নাম। পুরো নাম—মুহাম্মদ ইবনু ইসমাঈল ইবনু ইবরাহিম ইবনু মুগীরাহ ইবনু বার্দিজবাহ আল-বুখারী। জন্ম নেন ১৩ শাওয়াল, ১৯৪ হিজরিতে, খোরাসানের বিখ্যাত শহর বুখারায় (বর্তমান উজবেকিস্তান)।
🟢 পারিবারিক পটভূমি ও শৈশব:
তার পিতা ইসমাঈল ইবনে ইবরাহিম নিজেও হাদীসের একজন বিশ্বস্ত রাবি ছিলেন। অল্প বয়সেই পিতৃহীন হয়ে যান ইমাম বুখারী। মায়ের কোলে, দুঃখ-সংগ্রামের মধ্যেই বেড়ে ওঠেন। এক সময় শৈশবে তাঁর দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যায়, কিন্তু মায়ের দোয়ার বরকতে তা অলৌকিকভাবে ফিরে পান।
🟢 জ্ঞানার্জনের সূচনা:
মাত্র ৯ বছর বয়সে কুরআন হিফজ সম্পন্ন করেন। এরপর হাদীস মুখস্থে মনোনিবেশ করেন। মাত্র ১০ বছর বয়সেই স্থানীয় মুজতাহিদদের ভুল ধরতে সক্ষম হন। ১৬ বছর বয়সে আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক ও ওয়াকী ইবনে জাররাহ-এর রচনাবলি ও হাদীস-সংগ্রহ মুখস্থ করে ফেলেন।
🟢 অবদানের শীর্ষবিন্দু:
ইমাম বুখারীর শ্রেষ্ঠতম কীর্তি—"সহীহ আল-বুখারী"—যা বিশ্বের মুসলিম সমাজে বিশ্বস্ততম হাদীসগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। নির্ভুল সনদের কড়াকড়ি, সংকলনের পূর্বে বারবার ইস্তেখারা ও গোসল করার নীতি তাঁকে আলাদা মর্যাদায় নিয়ে যায়। এজন্য তাঁকে উপাধি দেওয়া হয়—"আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস"।
📚 সহীহ বুখারী: একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যালোচনা
ইসলামী জ্ঞানচর্চার জগতে "সহীহ বুখারী" একটি অবিস্মরণীয় নাম। পবিত্র কুরআনের পর সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের কাছে এটি সমাদৃত। এই নিবন্ধে আমরা সহীহ বুখারীর হাদিস সংখ্যা, সংকলনের ইতিহাস, সংকলকের জীবন এবং এর সনদসহ বিস্তারিত তথ্য জানব।
ইমাম বুখারী (রহঃ): সংকলকের জীবন ও কর্ম
সহীহ বুখারীর সংকলক হলেন ইমাম আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ বিন ইসমাইল বিন ইবরাহীম বিন মুগীরাহ বিন বারদিযবাহ আল-জু'ফী আল-বুখারী। তিনি ১৯৪ হিজরীর ১৩ই শাওয়াল (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) উজবেকিস্তানের বুখারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান এবং তার মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন।
শৈশব থেকেই তাঁর জ্ঞানার্জন ও হাদিস শাস্ত্রের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল। তাঁর स्मरणশক্তি ছিল প্রখর; বলা হয়ে থাকে যে তিনি সনদসহ ছয় লক্ষ হাদিসের হাফেজ ছিলেন। জ্ঞান অর্জনের জন্য তিনি তৎকালীন ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্র যেমন মক্কা, মদিনা, ইরাক, সিরিয়া, মিশরসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং এক হাজারেরও বেশি মুহাদ্দিসের কাছ থেকে হাদিস সংগ্রহ করেছেন।
সহীহ বুখারী সংকলনের ইতিহাস ও পদ্ধতি
সংকলনের প্রেরণা
ইমাম বুখারী (রহঃ) তাঁর উস্তাদ ইসহাক বিন রাহওয়াইহ (রহঃ) থেকে এই মহান গ্রন্থটি রচনার প্রেরণা লাভ করেন। একদিন ইসহাক (রহঃ) এমন একটি গ্রন্থের আশা প্রকাশ করেন যেখানে শুধুমাত্র সহীহ হাদিস সংকলিত থাকবে। মজলিসে উপস্থিত ছাত্রদের মধ্যে ইমাম বুখারী এই কঠিন দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হন।
সংকলনের সময়কাল ও পদ্ধতি
ইমাম বুখারী ২১৭ হিজরীতে মাত্র ২৩ বছর বয়সে মক্কা নগরীতে এই গ্রন্থের সংকলন কাজ শুরু করেন এবং দীর্ঘ ১৬ বছর পর এর কাজ সমাপ্ত হয়। তিনি প্রায় ৬ লক্ষ হাদিস থেকে যাচাই-বাছাই করে এই গ্রন্থটি সংকলন করেন। তাঁর সতর্কতা এমন পর্যায়ে ছিল যে, প্রতিটি হাদিস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করার আগে তিনি গোসল করে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করে ইস্তিখারা করতেন এবং হাদিসের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতেন।
তিনি কেবল সহীহ হাদিসই সংকলন করেননি, বরং সহীহ হাদিসগুলোর মধ্যে যেগুলো তাঁর নির্ধারিত কঠোর শর্তে উত্তীর্ণ হয়েছে, শুধুমাত্র সেগুলোকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। হাদিস গ্রহণের জন্য তাঁর অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল: হাদিসের বর্ণনাকারী (রাবী) তার পূর্ববর্তী বর্ণনাকারীর সমসাময়িক হতে হবে এবং উভয়ের মধ্যে সাক্ষাত হওয়া প্রমাণিত হতে হবে।
হাদিস সংখ্যা
সহীহ বুখারীর হাদিস সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন গণনায় কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। এই ভিন্নতার মূল কারণ হলো পুনরুল্লেখ (তাকরার) এবং شمار করার পদ্ধতির ভিন্নতা।
- পুনরুল্লেখসহ (তাকরারসহ) মোট হাদিস: প্রায় ৭,৫৬৩টি।
- পুনরুল্লেখ ব্যতীত (তাকরার ছাড়া) হাদিস: প্রায় ২,৬০২টি।
গ্রন্থটি মোট ৯৭টি অধ্যায়ে (কিতাব) বিভক্ত।
সনদ: হাদিস বর্ণনার নির্ভরযোগ্য শিকল
হাদিস শাস্ত্রে 'সনদ' বলতে হাদিসের বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিক পরম্পরাকে বোঝানো হয়, যা মূল হাদিস (মতন) পর্যন্ত পৌঁছেছে। ইমাম বুখারী সনদের বিশুদ্ধতার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বারোপ করেছেন। একটি হাদিস সহীহ হওয়ার জন্য এর সনদ অবিচ্ছিন্ন ও নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের দ্বারা গঠিত হওয়া আবশ্যক।
সনদের একটি উদাহরণ: সহীহ বুখারীর প্রথম হাদিস
হাদিস নং ১
সনদ:
হুমায়দী আবদুল্লাহ ইবনু যুবায়র (রহঃ) ⇢ সুফিয়ান (রহঃ) ⇢ ইয়াহইয়া ইবনু সাঈদ আনসারী (রহঃ) ⇢ মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম তায়মী (রহঃ) ⇢ আলক্বামাহ ইবনু ওয়াক্কাস আল-লায়সী (রহঃ) ⇢ উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) ⇢ রাসূলুল্লাহ (ﷺ)
মতন (মূল বক্তব্য):
উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) মিম্বরে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি: "সমস্ত কাজের ফলাফল নিয়্যাতের উপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিয়্যাত অনুযায়ী ফল পাবে। সুতরাং যার হিজরত দুনিয়া লাভের জন্য বা কোনো মহিলাকে বিবাহ করার উদ্দেশ্যে হবে, তার হিজরত সেই উদ্দেশ্যেই গণ্য হবে, যার জন্য সে হিজরত করেছে।"
এই সনদে দেখা যাচ্ছে, ইমাম বুখারী হুমায়দী (রহঃ) থেকে হাদিসটি শুনেছেন এবং এই বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিকতা উমার (রাঃ) হয়ে রাসূল (ﷺ) পর্যন্ত পৌঁছেছে। ইমাম বুখারী এই প্রত্যেক বর্ণনাকারীর নির্ভরযোগ্যতা এবং তাদের মধ্যকার সাক্ষাৎ প্রমাণিত হওয়ার পরেই হাদিসটি গ্রহণ করেছেন।
ইমাম বুখারীর যুগ, সাহাবাদের সান্নিধ্য এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপট
সাহাবাদের সান্নিধ্য প্রসঙ্গ
একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ইমাম বুখারী (রহঃ) কোনো সাহাবীর (রাঃ) সান্নিধ্য বা সাক্ষাৎ লাভ করেছিলেন কিনা। এর সুস্পষ্ট উত্তর হলো— না, তিনি কোনো সাহাবীর সাক্ষাৎ পাননি।
এর কারণ হলো সময়ের ব্যবধান। ইমাম বুখারী ১৯৪ হিজরীতে (৮১০ খ্রিস্টাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন এবং ২৫৬ হিজরীতে (৮৭০ খ্রিস্টাব্দ) মৃত্যুবরণ করেন। অপরদিকে, সর্বশেষ সাহাবী আবু তুফাইল আমির ইবনে ওয়াসিলা (রাঃ) প্রায় ১০২ থেকে ১১০ হিজরীর মধ্যে ইন্তেকাল করেন। সুতরাং, সর্বশেষ সাহাবীর মৃত্যুর প্রায় ৮৪ বছর পর ইমাম বুখারী জন্মগ্রহণ করেন।
ইসলামী পরিভাষায় যারা সাহাবাদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন, তাদের 'তাবেঈ' বলা হয়। আর যারা তাবেঈদের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন কিন্তু কোনো সাহাবীর সাক্ষাৎ পাননি, তাদের 'তাবে-তাবেঈন' বলা হয়। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইমাম বুখারী (রহঃ) ছিলেন একজন উঁচু স্তরের তাবে-তাবেঈন, কারণ তিনি বহু সংখ্যক তাবেঈদের কাছ থেকে হাদিস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেছেন।
তৎকালীন সামাজিক ও জ্ঞানচর্চার পরিবেশ
ইমাম বুখারী (রহঃ) আব্বাসীয় খিলাফতের স্বর্ণযুগে জীবনযাপন করেন। এই যুগটি ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষের সময়। খলিফা হারুন-অর-রশিদ এবং বিশেষ করে তাঁর পুত্র আল-মামুনের শাসনামলে বাগদাদ বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। আল-মামুন বিখ্যাত "বায়তুল হিকমাহ" (House of Wisdom) প্রতিষ্ঠা করেন, যা ছিল একাধারে গ্রন্থাগার, অনুবাদ কেন্দ্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এখানে গ্রিক, পারস্য, ভারতীয় এবং সিরীয় ভাষার অসংখ্য গ্রন্থ আরবিতে অনুবাদ করা হয়, যা এক অভূতপূর্ব জ্ঞান বিপ্লবের সূচনা করে।
এই সময়ে ভূগোল, গণিত, চিকিৎসাশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা এবং দর্শনসহ জ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম পণ্ডিতদের মৌলিক অবদান বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এমন একটি জ্ঞানকেন্দ্রিক পরিবেশে ইমাম বুখারী বেড়ে ওঠেন, যা তাঁকে জ্ঞানার্জনের জন্য দেশ-দেশান্তরে ভ্রমণ করতে এবং হাদিস সংগ্রহের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞে আত্মনিয়োগ করতে উৎসাহিত করেছিল।
হাদিস শাস্ত্রের অবস্থা
আব্বাসীয় যুগ হাদিস সংকলন ও শাস্ত্রীয় গবেষণার জন্যও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইমাম বুখারীর পূর্বেই হাদিস সংকলনের কাজ চলছিল। অনেক মুহাদ্দিস তখন হাদিস সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করছিলেন। তবে সেই গ্রন্থগুলোতে সহীহ (বিশুদ্ধ), হাসান (উত্তম) এবং যঈফ (দুর্বল)—এই সকল প্রকার হাদিস একসাথে সংকলিত ছিল।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতো হাদিস শাস্ত্রেও একটি সুশৃঙ্খল ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। জাল হাদিসের ছড়াছড়ি এবং দুর্বল বর্ণনার মিশ্রণ থেকে সহীহ হাদিসকে আলাদা করার একটি নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করা ছিল সময়ের দাবি। এই প্রেক্ষাপটে ইমাম বুখারীর আবির্ভাব হয়। তিনি সনদের প্রতিটি বর্ণনাকারীর জীবন ও নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করার ('ইলম আল-রিজাল') এবং হাদিসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের এমন কঠোর মানদণ্ড স্থাপন করেন, যা পূর্বে আর কেউ করেননি। তাঁর এই титанический প্রচেষ্টার ফসলই হলো "আল-জামি' আল-মুসনাদ আস-সহীহ" বা সহীহ বুখারী, যা কেবল সহীহ হাদিসকে স্থান দেওয়ার কারণে মুসলিম বিশ্বে অভূতপূর্ব গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে।
উপসংহার
সহীহ বুখারী কেবল একটি হাদিস গ্রন্থই নয়, বরং এটি ইমাম বুখারীর ১৬ বছরের কঠোর পরিশ্রম, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি এবং হাদিস সংরক্ষণে তাঁর সর্বোচ্চ সতর্কতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আব্বাসীয় যুগের জ্ঞানভিত্তিক জাগরণের মাঝে থেকেও তিনি পার্থিব জ্ঞানের পরিবর্তে আল্লাহর রাসূল (ﷺ)-এর বাণীকে বিশুদ্ধরূপে সংরক্ষণ করাকেই জীবনের ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য এটি পবিত্র কুরআনের পর জ্ঞান ও নির্দেশনার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস হিসেবে আজও তার স্থান ধরে রেখেছে।

সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম—কেন “সহীহাইন”
বুখারী ও মুসলিম শরীফ ইসলামী জগতে সহীহাইন নামে পরিচিত, কারণ এই দুই গ্রন্থে সংকলিত হাদিসসমূহকে মুসলিম উম্মাহ সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য বলে মেনে নেয়। এর মূল কারণ ইমাম বুখারী (রহ.) ও ইমাম মুসলিম (রহ.)-এর কঠোর তাহকীক—বর্ণনাকারীদের আদালত (ধর্মীয় সততা) ও দাবত (স্মরণশক্তি/সংরক্ষণ ক্ষমতা) যাচাই, বর্ণনা-শৃঙ্খলের ইত্তিসাল (অবিচ্ছিন্ন সংযোগ) নিশ্চিত করা, এবং বর্ণনায় শুযূয (বিশ্বাসযোগ্য বিরোধ) ও ইল্লাহ (গোপন ত্রুটি) না থাকা।
সনদ ও متن (Matn) কী?
সনদ হলো বর্ণনাকারীদের ধারাবাহিক তালিকা, যার মাধ্যমে হাদিস নবী মুহাম্মদ ﷺ পর্যন্ত পৌঁছায়। متن/মতন হলো সেই বয়ানের মূল বক্তব্য বা শব্দাবলি। সহীহাইন রচয়িতারা সনদের নির্ভরযোগ্যতা ও মতনের সামঞ্জস্য—উভয় দিকই সূক্ষ্মভাবে যাচাই করেছেন।
ইমাম বুখারীর মানদণ্ড (সংক্ষেপ)
- প্রতিটি বর্ণনাকারীর সাথে পরের বর্ণনাকারীর প্রকৃত সাক্ষাৎ/সমসাময়িকতা যাচাই।
- বর্ণনাকারীর ধার্মিকতা, সততা ও শক্তিশালী স্মৃতিশক্তি নিশ্চিতকরণ।
- মতনের অর্থ ও শব্দে পূর্বসূরি সহীহ বর্ণনাকে বিরোধ না করা।
(সহীহ বুখারীতে মোট হাদিস পুনরাবৃত্তিসহ আনুমানিক ৭,০০০+; পুনরাবৃত্তি বাদে ~২,৬০০।)
ইমাম মুসলিমের পদ্ধতি (সংক্ষেপ)
- একই হাদিসের একাধিক নির্ভরযোগ্য সনদ একত্রে উপস্থাপন করে পার্থক্য স্পষ্ট করা।
- শব্দভেদ (لفظ) ও অর্থভেদে সূক্ষ্ম তুলনা—শুযূয ও ইল্লাহ শনাক্ত।
- বর্ণনাকারী-সমালোচকদের (জরহ-তা’দীল) মানদণ্ড কঠোরভাবে অনুসরণ।
(সহীহ মুসলিমে হাদিস পুনরাবৃত্তিসহ ~৯,০০০; পুনরাবৃত্তি বাদে ~৪,০০০।)
আরও কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য
- ইত্তিসালুস সনদ: বর্ণনা-শৃঙ্খলে কোনো ছেদ নেই; প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে শোনা/মিলিত।
- শুযূয: নির্ভরযোগ্যদের অধিকাংশ বর্ণনার বিরোধী একক বা অস্বাভাবিক বর্ণনা।
- ইল্লাহ: গভীর অনুসন্ধান ছাড়া ধরা না পড়া গোপন ত্রুটি (যেমন, নামের সামান্য রদবদল, সংযোগে সূক্ষ্ম ভুল)।
- দুই ইমামই বর্ণনাকারীদের জীবনবৃত্তান্ত (রিজাল) নিয়ে প্রাচীন সমালোচকদের সিদ্ধান্তকে ভিত্তি হিসেবে নিয়েছেন।
রেফারেন্স (ধ্রুপদি গ্রন্থসমূহ)
- ইবনু সালাহ, মুকাদ্দিমাহ ফি উলূমিল হাদিস (মুকাদ্দিমাহ্ ইবনুস্ সালাহ্)।
- ইবনু হাজার আল-আসকালানী, নুখবাতুল ফিকর ও নুযহাতুন নজর (শরহ)।
- আল-খতীব আল-বাগদাদী, আল-কিফায়াহ ফি ইলমির রিওয়ায়াহ।
- ইমাম আন-নববী, মুকাদ্দিমাহ শরহ সহীহ মুসলিম।
- ইমাম বুখারী, সহীহুল বুখারী—“কিতাবুল ইলম” প্রভৃতি অধ্যায়ের ভূমিকাসমূহ।
- ইমাম মুসলিম, সহীহ মুসলিম—মুকাদ্দিমাহ (রাবী যাচাই ও শুযূজ/ইল্লাহ আলোচনা)।
0 Comments