গ্রিন টি ও ব্ল্যাক কফি—উভয়েই ক্যাফেইন রয়েছে, যা স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় করে ও মেটাবলিজম বাড়ায়।
চা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ক্লান্তি দূর করা, কাজের মাঝে একটু বিরতি কিংবা আড্ডার সঙ্গী হিসেবে চায়ের জুড়ি মেলা ভার। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতার এই যুগে অনেকেই সাধারণ দুধ চায়ের পরিবর্তে গ্রিন টি বা ব্ল্যাক টি-কে বেছে নিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই দুই প্রকার চায়ের মধ্যে কোনটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য বেশি উপকারী? চলুন, জেনে নেওয়া যাক বিস্তারিত।
গ্রিন টি: (Green Tea) অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভান্ডার
গ্রিন টি তৈরি করার জন্য চা পাতা সংগ্রহ করে শুকিয়ে নেওয়া হয় এবং তারপর প্যানে গরম করা হয়। এর ফলে পাতাগুলো অক্সিডাইজড হয় না এবং এর প্রাকৃতিক সবুজ রঙ ও ফ্লেভার বজায় থাকে। এই প্রক্রিয়ার কারণেই গ্রিন টি-তে প্রচুর পরিমাণে এপিগ্যালোক্যাটেচিন গ্যালেট (EGCG) নামক একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে।
উপকারিতা:
- হৃৎপিণ্ডের স্বাস্থ্য: গ্রিন টি-তে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্ডিওভাসকুলার রোগ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। এটি খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) এর অনুপাত উন্নত করতে সহায়তা করে।
- ওজন নিয়ন্ত্রণ: গবেষণায় দেখা গেছে, গ্রিন টি-তে থাকা ক্যাটেচিন মেটাবলিজম বা বিপাকক্রিয়া বাড়াতে সাহায্য করে, যা ফ্যাট বার্ন করতে এবং ওজন কমাতে সহায়ক হতে পারে।
- মস্তিষ্কের কার্যকারিতা: গ্রিন টি-তে ক্যাফেইন এবং এল-থিয়ানিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিডের সংমিশ্রণ মস্তিষ্কের কার্যকারিতা, সতর্কতা এবং মেজাজ উন্নত করতে সাহায্য করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা: এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং ডিটক্সিফাই করতেও সাহায্য করে।
- কম ক্যাফেইন: ব্ল্যাক টি-র তুলনায় গ্রিন টি-তে ক্যাফেইনের পরিমাণ কম থাকে।
স্বতন্ত্র উপকারিতা:
- শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (EGCG): গবেষণায় এর ক্যান্সার-বিরোধী বৈশিষ্ট্য, স্নায়ুতন্ত্রের উন্নতি, লিভারের সুরক্ষা এবং প্রদাহ-বিরোধী প্রভাব দেখা গেছে।
- হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য: Very Well Fit-এর মতে, এটি রক্তচাপ এবং LDL ("খারাপ") কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে, যা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়।
- প্রশান্তিদায়ক প্রভাব: এতে সামান্য বেশি পরিমাণে এল-থিয়ানিন (L-theanine) অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা ক্যাফেইনের প্রভাবকে মৃদু করে এবং মানসিক প্রশান্তি ও মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করে।
প্রতি ৮-আউন্স (২৩৭ মিলি) কাপে প্রায় ২৯ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে।
ব্ল্যাক টি:(Black Tea) শক্তি ও মনোযোগের উৎস
ব্ল্যাক টি তৈরির জন্য চা পাতা তুলে শুকিয়ে গুঁড়িয়ে নেওয়া হয় এবং তারপর সেগুলোকে অক্সিডাইজড বা জারিত করা হয়। এই জারণ প্রক্রিয়ার ফলেই এর রঙ কালচে-বাদামী হয় এবং এর তীব্র সুগন্ধ ও স্বাদ তৈরি হয়। এই প্রক্রিয়ার সময় EGCG থিয়াফ্ল্যাভিন এবং থিয়ারুবিজিনে রূপান্তরিত হয়।
উপকারিতা:
- হৃৎপিণ্ডের জন্য উপকারী: ব্ল্যাক টি-তে থাকা থিয়াফ্ল্যাভিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালীকে রক্ষা করে, এবং রক্তে শর্করা ও কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- মনোযোগ বৃদ্ধি: ব্ল্যাক টি-তে থাকা এল-থিয়ানিন নামক অ্যামাইনো অ্যাসিড মনোযোগ বাড়াতে এবং মনকে রিল্যাক্স করতে সাহায্য করে।
- মানসিক সতর্কতা: ক্যাফেইন এবং এল-থিয়ানিনের সংমিশ্রণ মানসিকভাবে সতর্ক থাকতে সাহায্য করে।
- হাড়ের স্বাস্থ্য: কিছু গবেষণা অনুযায়ী, নিয়মিত ব্ল্যাক টি পান করলে হাড়ের ঘনত্ব উন্নত হতে পারে, যা অস্টিওপরোসিসের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
- গাট হেলথ: ব্ল্যাক টি-তে থাকা পলিফেনল উপকারী গাট ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে।
স্বতন্ত্র উপকারিতা:
- অনন্য অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট (থিয়াফ্ল্যাভিনস): এই যৌগগুলো ফ্যাট সেলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে এবং স্থূলতা কমানো, লিপিডের মাত্রা হ্রাস ও অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে সমর্থন করার মতো সুবিধা প্রদান করে।
- হৃদপিণ্ডের জন্য উপকারী: এটিও কার্যকরভাবে রক্তচাপ, LDL কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইড কমাতে সাহায্য করে, যা হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখে।
- হালকা এনার্জি বুস্ট: গ্রিন টি-র চেয়ে বেশি ক্যাফেইন থাকায় এটি কফির মতো তীব্র না হয়েও মানসিক সতর্কতা এবং শক্তি বাড়াতে বেশি কার্যকর।
প্রতি ৮-আউন্স (২৩৭ মিলি) কাপে প্রায় ৪৭ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে।
তুলনামূলক আলোচনা ও সিদ্ধান্ত
গ্রিন টি এবং ব্ল্যাক টি উভয়ই ক্যামেলিয়া সিনেনসিস নামক একই গাছ থেকে তৈরি হয়। এদের প্রধান পার্থক্য প্রক্রিয়াজাতকরণের পদ্ধতিতে, যা এদের অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের গঠনে ভিন্নতা নিয়ে আসে।
ক্যাফেইন ও মনোযোগ: যদি আপনি দিনের শুরুতে কফির বিকল্প হিসেবে হালকা শক্তিদায়ক পানীয় চান যা মনোযোগ বাড়াতে সাহায্য করবে, তবে ব্ল্যাক টি-র বেশি ক্যাফেইন (৪৭ মিলিগ্রাম) আপনার জন্য ভালো বিকল্প। অন্যদিকে, যারা ক্যাফেইনের প্রতি বেশি সংবেদনশীল বা একটি শান্ত ও প্রশান্তিদায়ক পানীয় চান, তাদের জন্য গ্রিন টি (২৯ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন ও বেশি এল-থিয়ানিন) সেরা পছন্দ।
আর যারা ক্যাফেইনের প্রতি সংবেদনশীল, তাদের জন্য গ্রিন টি একটি ভালো বিকল্প কারণ এতে ব্ল্যাক টি-র তুলনায় কম ক্যাফেইন থাকে। এক কাপ গ্রিন টি-তে প্রায় ২০-৪৫ মিলিগ্রাম ক্যাফেইন থাকে, যেখানে এক কাপ ব্ল্যাক টি-তে থাকে প্রায় ৪০-৭০ মিলিগ্রাম।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট: যদিও গ্রিন টি তার EGCG-এর জন্য প্রশংসিত, ব্ল্যাক টি-র থিয়াফ্ল্যাভিন এবং থিয়ারুবিজিনও স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তবে ক্যাটেচিনের পরিমাণ ও গুণমানের দিক থেকে গ্রিন টি এগিয়ে থাকে।
কোনটি বেছে নেবেন? যদি আপনার মূল লক্ষ্য ওজন কমানো এবং শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের উপকারিতা পাওয়া হয়, তাহলে গ্রিন টি আপনার জন্য সেরা বিকল্প হতে পারে। অন্যদিকে, যদি আপনি দিনের শুরুতে একটি শক্তিশালী এনার্জি বুস্ট এবং মনোযোগ বাড়াতে চান, তাহলে ব্ল্যাক টি বেছে নিতে পারেন।
পরিশেষে বলা যায়, গ্রিন টি এবং ব্ল্যাক টি উভয়ই স্বাস্থ্যকর পানীয়। আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ এবং স্বাস্থ্যের লক্ষ্যের উপর নির্ভর করে যেকোনো একটিকে বেছে নিতে পারেন। পরিমিত পরিমাণে পান করলে উভয় প্রকার চা-ই আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হতে পারে।
0 Comments