ঋণ পরিশোধ হবেই যদিও তা পাহাড়পরিমাণও হয় || মহানবী (সা.) যে দোয়া পড়তে বলেছেন
আর্থিক সংকটে পড়লে অনেকেই বাধ্য হয়ে ঋণ নিতে পারেন।
ঋণের টাকা দিয়ে তারা জীবনের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ইসলাম কঠোরভাবে সাধ্যের বাইরে ঋণ দেওয়া-নেওয়া নিষিদ্ধ করেছে। কারণ অতিরিক্ত ঋণ সময়মতো পরিশোধের সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করে দেয়।
ফলে, ঋণদাতা হতাশায় ভুগে, আর ঋণগ্রহীতা মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে—তার আত্মমর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সুতরাং, আর্থিক দায়ে সাবধানতা অবলম্বন করাই হলো সত্যিকার মুক্তির পথ।
"প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সব সময় ঋণগ্রস্ত হওয়া থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে এভাবে প্রার্থনা করতেন।"
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন,
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ، وَالْهَرَمِ والْمَأثَمِ وَ الْمَغْرَمِ
‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিনাল কাসালি, ওয়াল হারামি, ওয়াল মাছামি, ওয়াল মাগরামি।’
হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গুনাহ এবং ঋণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
— (বুখারি, হাদিস: ৬,০০৭)
ঋণের সুদ মানুষকে ধ্বংস করে
ইসলাম ধর্মে সুদ (রিবা) কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ এটি সমাজে শোষণ, দারিদ্র্য, বৈষম্য ও নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করে। কোরআন ও হাদিসে সুদখোরদের জন্য কঠিন শাস্তির বর্ণনা এসেছে।
📖 কোরআনের বক্তব্য
“যারা সুদ খায়, তারা কিয়ামতের দিনে দাঁড়াবে ঠিক সেই লোকের মতো যাকে শয়তান স্পর্শ করে পাগল বানিয়ে দিয়েছে।”
— সুরা আল-বাকারাহ: ২৭৫
📜 হাদিসের বর্ণনা
রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ “সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে তোমরা বেঁচে থাকো।” সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এগুলো কী কী? তিনি বললেন— আল্লাহর সাথে শরিক করা, জাদু করা, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, ইয়াতিমের সম্পদ ভক্ষণ করা, যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং নিরপরাধ নারীদের অপবাদ দেওয়া।”
— সহিহ বুখারি ২৭৬৬, সহিহ মুসলিম ৮৯
রাসুলুল্লাহ ﷺ আরও বলেছেনঃ “এক দিরহাম সুদ খাওয়া আল্লাহর কাছে ৩৬ বার ব্যভিচার করার চেয়েও গুরুতর।”
— মুসনাদ আহমদ ২: ২২৫, হাকিম ২: ৩৭
👉 তাই, ইসলামে সুদ কেবল গুনাহ নয় বরং মানুষের আত্মিক, মানসিক ও সামাজিক জীবনে ধ্বংস ডেকে আনে। মুসলমানদের উচিত সুদ থেকে সর্বদা দূরে থাকা এবং হালাল উপার্জনের পথ বেছে নেওয়া।
ঋণ থেকে মুক্তির জন্য কোরআন-হাদিসের অনুপ্রেরণামূলক দোয়া ও শিক্ষা
জীবনের এক একটি ধাপেই অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি। ঋণ প্রকৃতপক্ষে কারো জীবনের জন্য সুখবর নয়। এটি কখনোই আমাদের মুক্তি কিংবা শান্তির পথ হতে পারে না। তাই জীবনের সর্বদা আমাদের উচিত ঋণ থেকে মুক্ত থাকার চেষ্টা করা। কোরআন ও হাদিস শরিফে ঋণ থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ ও কার্যকর দোয়া বর্ণিত রয়েছে, যা আমাদের এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির পথ দেখাতে পারে।
ঋণ যথাসময়ে পরিশোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঋণ প্রদানকারীর প্রতি ঋণগ্রহীতার এটি বাধ্যতামূলক কর্তব্য। এমনকি ঋণগ্রহীতা মৃত্যুর পর তার সম্পদ থেকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করতে হয়। ঋণ পরিশোধের পর অতিরিক্ত সম্পদ ওয়ারিশদের মাঝে ভাগ করা হয়।
— সূত্র: ইসলামিক ফিকহ
সাহাবী হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,
“যে ব্যক্তি পরিশোধের নিয়তে কারও নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করে, আল্লাহ তা‘আলা তার পক্ষ থেকে তা আদায় করে দেন।”
— সহিহ বুখারী: ২৩৮৭
হাদিসে আরও এসেছে,
“উহুদ পাহাড় স্বর্ণে পরিণত হলেও আমি চাই না এর একটি দিনার আমার কাছে তিন দিনের বেশি সময় থাকুক, যদি সেটা ঋণ পরিশোধের জন্য না রাখা হয়।”
— সহিহ বুখারী: ২৩৮৮
অর্থাৎ, ঋণ পরিশোধের সময়মতো দায়িত্ব পালন করা শুধু দায়িত্ব নয়, বরং আল্লাহর কাছে আমানত রক্ষা করার একটি মহান কাজ।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দোয়া
আর একটি দোয়ার কথা হাদিসে এসেছে,
হজরত আবু সাঈদ খুদরি রাদিআল্লাহু আনহু বলেন, একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা।
রসুল তাকে বললেন, আবু উমামা! ব্যাপার কী, নামাজের সময় ছাড়াও তোমাকে মসজিদে বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে?
আবু উমামা বললেন, ইয়া রসুলাল্লাহ! অনেক ঋণ এবং দুনিয়ার চিন্তা আমাকে গ্রাস করে রেখেছে। তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, আমি কি তোমাকে এমন কিছু কালিমা শিখিয়ে দেব, যেগুলো বললে আল্লাহ তায়ালা তোমার চিন্তাকে দূর করে দেবেন এবং তোমার ঋণগুলো আদায় করে দেবেন।
তিনি বলেন, জি হ্যাঁ ইয়া রসুলাল্লাহ! অবশ্যই বলুন, তখন রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে নিম্নের দোয়াটি শিখিয়ে দেন এবং তা সকাল সন্ধ্যায় পড়তে বলেন।
আবু উমামা বলেন, আমি রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ দোয়াটি পড়তে লাগলাম ফলে আল্লাহ তায়ালা আমার চিন্তা দূর করে দিলেন এবং আমার ঋণগুলোও আদায় করে দিলেন।
দোয়াটি হলো-
اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَالْكَسَلِ، وَالْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَضَلَعِ الدَّيْنِ وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ
একজন মুমিন ব্যক্তির জন্য ঋণের বোঝার চেয়ে ভারি কিছু নেই। কারণ, ঋণ হচ্ছে মানুষের হক—এতে আল্লাহ ক্ষমা করলেও, ঋণদাতার অধিকার আদায় না হলে মুক্তি মেলে না। সুতরাং, কেউ যদি ঋণগ্রস্ত কারো ঋণ মাফ করে দেয়, তবে তার জন্য আখিরাতে রয়েছে এক বিশাল প্রতিদান। এই বিষয়ে স্পষ্ট ঘোষণা এসেছে হাদিসে।
একবার এক ব্যক্তি ঋণমুক্তির উদ্দেশ্যে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রাঃ)-এর কাছে আর্থিক সাহায্য চাইলে তিনি বললেন,
“আমি কি তোমাকে এমন কিছু শব্দ শিখাবো, যা আমাকে রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) শিখিয়েছেন? যদি তুমি সেগুলো পাঠ করো, তাহলে আল্লাহই তোমার ঋণমুক্তির ব্যবস্থা করে দেবেন—even যদি তোমার ঋণ পর্বতের মতো বিশাল হয়।”
এরপর হজরত আলী (রাঃ) তাকে এই দোয়াটি শিখিয়ে দিলেন:
اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلَالِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
**উচ্চারণ:** আল্লাহুম্মাকফিনী বিহালালিকা আন হারামিকা, ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল দ্বারা যথেষ্ট করুন, যাতে আমি হারাম থেকে বাঁচতে পারি। এবং আপনি ব্যতীত অন্য কারো মুখাপেক্ষী না হয়ে, আপনার অনুগ্রহেই আমাকে সচ্ছল করে দিন।
(তিরমিজি: হাদিস ৩৫৬৩; মুসনাদে আহমদ: ১৩২১)
🟢 যে দোয়া পড়লে পাহাড় সমান ঋণ থেকেও মুক্তি পাওয়া যাবে ইনশাআল্লাহ। - শাইখ আহমাদুল্লাহ ( Video )
উপরের ভিডিওতে বর্ণিত দোয়াটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রদত্ত একটি দোয়া, যা ঋণমুক্তি ও আর্থিক সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। তিনি এই দোয়াটি সাহাবিদের শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং এর মাধ্যমে হালাল রিজিকের প্রার্থনা ও আল্লাহর অনুগ্রহ কামনা করা হয়। নিয়মিত এই দোয়াটি পাঠ করলে, ইনশাআল্লাহ, ঋণের বোঝা লাঘব হবে এবং আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জিত হবে।
হাদিসে উল্লেখিত ঋণমুক্তির দোয়া
হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদের জন্য একটি বিশেষ দোয়া শিক্ষা দিয়েছেন, যা ঋণ ও অন্যান্য বিপদ থেকে মুক্তি দেয়। দোয়াটি হলো:
اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكَ عَمَّنْ سِوَاكَ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাকফিনী বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়া আগনিনি বিফাদলিকা আম্মান সিওয়াক্।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল বিষয় দ্বারা হারাম থেকে রক্ষা করুন এবং আপনার করুণা দ্বারা অন্যদের থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী করে দিন।
— জামে তিরমিজি: ৩৫৬৩
যারা সচ্ছল ও শান্তিতে আছেন, তাদের জন্য এই দোয়া কঠিন বিপদ, ঋণ, অলসতা ও অসক্ষমতা থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ সহায়ক। যারা ইতোমধ্যে এই বিপদে পড়েছেন, তাদের জন্যও এই দোয়া আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনার একটি শক্তিশালী মাধ্যম।
‘মানুষ ঋণী হলে কথা বলতে গিয়ে মিথ্যা বলে এবং অঙ্গীকার করলে, তা রক্ষা করে না।’
— সহিহ বুখারী, হাদিস নং: ২৩৯৭
🟢 ঋণ মুক্তির এবং কোটিপতি হওয়ার শক্তিশালী আমল! মিজানুর রহমান আজহারী। Mizanur Rahman Azhari ( Video )
এই দোয়াটি শুধুমাত্র ঋণমুক্তির একটি মাধ্যম নয়, বরং এটি একজন মুমিনের আর্থিক স্বাধীনতার জন্য আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা প্রকাশের বহিঃপ্রকাশ। মহানবী (সা.) সাহাবিদের শিখিয়েছেন যে, হালাল রিজিকের মাধ্যমে জীবিকা অর্জন এবং পরনির্ভরশীলতা থেকে মুক্ত থাকার জন্য এই দোয়াটি পাঠ করা অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। যে ব্যক্তি আন্তরিকতা ও নিয়মিততার সাথে এই দোয়া পাঠ করবে, আল্লাহ তার জন্য রিজিকের দরজা খুলে দেবেন এবং দুনিয়া ও আখিরাতে প্রশান্তি দান করবেন।
উপসংহার
ঋণমুক্তি এবং আর্থিক সফলতা অর্জনের জন্য আমল বা দোআ যতই শক্তিশালী হোক না কেন, তা তখনই কার্যকর হয় যখন একজন ব্যক্তি আন্তরিকতা, ধৈর্য এবং পরিশ্রমের সাথে তা পালন করেন। ইসলামে দোআ, ইস্তেগফার, এবং নির্দিষ্ট আমলগুলো আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। যেমন:
➣ প্রতিদিন আয়াতুল কুরসি, সূরা আল-ওয়াকিয়া, এবং ইস্তেগফার পাঠ করা,
➣ নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়া এবং আল্লাহর কাছে হালাল রিজিকের দোআ করা,
➣ নিজের উপার্জনকে হালাল রাখা এবং সাদকাহ প্রদান করা।
তবে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র আমল করলেই সব কিছু হবে না — এর সাথে থাকা চাই পরিকল্পনা, কষ্টসহিষ্ণুতা ও কঠোর পরিশ্রম। দোআ ও চেষ্টা একসাথে মিলেই আসে প্রকৃত সাফল্য ও বরকত।
সুতরাং, আমল করুন বিশ্বাস নিয়ে, কাজ করুন নিষ্ঠা নিয়ে — ইনশাআল্লাহ ঋণ মুক্তি ও সম্পদ দুটোই আপনার ঝুলিতে আসবে।
ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, তবে এটি যেন আমাদের জন্য অভিশাপ না হয়, সেজন্য সময়মতো দায়িত্ব পালন এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা অপরিহার্য। নিয়মিত উপরে বর্ণিত দোয়া পাঠ এবং নৈতিক জীবনাচরণ ঋণের বোঝা থেকে মুক্তির জন্য আমাদের শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে।
আল্লাহ আমাদের সকলকে ঋণমুক্তি এবং জীবনের সকল কঠিন মুহূর্ত থেকে মুক্তি দান করুন। আমিন।
ঋণ থেকে মুক্তির দোয়া সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর
(বুখারি, হাদিস: ৬০০৭)
0 Comments