ভ্রমণে বা গাড়িতে উঠলে বমি-মাথা ঘোরানোর সমস্যা? মোশন সিকনেস: লক্ষণ, রোগ নির্ণয় এবং যত্ন !
বিশেষ করে দীর্ঘ সফরের ক্ষেত্রে এই সমস্যা বেশি হয়। ফলে অনেকেই গাড়ি বা বাসে করে লম্বা সফর করতে চায় না। মেডিকেলের ভাষায় এই সমস্যার নাম 'মোশন সিকনেস' বা 'কাইনেটোসিস'।
মোশন সিকনেস কী?
মোশন সিকনেস হলো একটি শারীরিক অবস্থা, যেখানে একজন ব্যক্তি যাত্রা বা চলাফেরার সময় শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করে। এটি সাধারণত ঘটে যখন মস্তিষ্ক, চোখ ও ভেতরের কানের ভারসাম্য সেন্সরগুলোর মধ্যে অসামঞ্জস্য হয়। ফলে মাথা ঘোরা, বমি ভাব, মাথা ব্যথা, ঘাম, ক্লান্তি এবং চোখের ঝাপসা বা দৃষ্টি অস্পষ্টতা দেখা দিতে পারে। সাধারণত গাড়ি, বাস, ট্রেন, নৌকা বা বিমান চলাচলের সময় এই সমস্যা বেশি হয়।
এ বিষয়ে ভারতীয় চিকিৎসক অরিন্দম বিশ্বাস বলছেন, চোখ, কান ও মস্তিষ্কের সমন্বয় চলাফেরার ও কাজকর্মের জন্য জরুরি। কোনো কারণে এই সমন্বয় বিঘ্নিত হলে ‘মোশন সিকনেস’ হতে পারে।
গাড়িতে চড়লেই বমি পায়? জেনে নিন সমাধান
বাস, ট্রেন বা প্লেনে উঠলেই অস্বস্তি? লম্বা ভ্রমণ আতঙ্কে ভোগার দিন শেষ। মোশন সিকনেস প্রতিরোধের বিজ্ঞানসম্মত উপায়গুলো জেনে নিন।
🚗✈️ দূরপাল্লার যাত্রা? নাকি দুঃস্বপ্ন? আপনার কি এমন অভিজ্ঞতা হয়েছে, যেখানে বাস, ট্রেন বা উড়োজাহাজে ওঠার কয়েক মিনিটের মধ্যেই পেটের ভেতর কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হলো? বমি বমি ভাব, মাথা ঘোরা আর চূড়ান্ত অসুস্থতায় মুহূর্তের মধ্যে পুরো আনন্দটাই মাটি! এই পরিচিত সমস্যাটিই হলো মোশন সিকনেস (Motion Sickness), যা আসলে যানবাহনে যাত্রাকালীন আমাদের শরীরের একটি অনৈচ্ছিক প্রতিক্রিয়া।
দুর্ভাগ্যক্রমে, যারা এতে ভোগেন, তারা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে ভয় পান এবং প্রায়শই অন্যদের সামনে বিব্রতবোধ করেন। ছোটদের মধ্যে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তবে বড়রাও এই অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে মুক্ত নন। চলুন, এই 'ভ্রমণ-ভীতি'র কারণ ও এর বিজ্ঞানসম্মত প্রতিরোধের উপায়গুলো খুঁজে বের করি।
ভ্রমণে বমি কেন হয়?
বমির জন্য দায়ী হলো আমাদের **অন্তঃকর্ণের** (কানের ভেতরের অংশ) এবং **চোখের সংকেতের মধ্যে সমন্বয়হীনতা**।
চলন্ত বাসের ঝাঁকুনিতে কানের ভেতরের ফ্লুইড নড়াচড়া করে, যা অন্তঃকর্ণের মাধ্যমে মস্তিষ্ককে বার্তা দেয় যে, শরীর **গতিশীল**। কিন্তু একই সময়ে, আমাদের চোখ গাড়ির ভেতরের স্থির বস্তুর দিকে তাকিয়ে মস্তিষ্ককে বার্তা দেয় যে, শরীর **স্থির** আছে।
এই দুই ধরনের অসংলগ্ন তথ্যের জন্য মস্তিষ্কে **সমন্বয়হীনতার** সৃষ্টি হয়। মস্তিষ্ক এই অবস্থাকে ভুলবশত **‘বিষ’** হিসেবে শনাক্ত করে এবং সেই ‘বিষ’ শরীর থেকে বের করে দেওয়ার জন্য বমি বা বমি বমি ভাবের সৃষ্টি হয়।
তথ্যসূত্র: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
মোশন সিকনেসের লক্ষণ
- মাথা ঘোরা এবং ভারসাম্য হারানো
- বমি বা বমি বমি ভাব
- হালকা মাথা ব্যথা বা মাথা ভারি লাগা
- পেট খারাপ বা অস্বস্তি
- ঘাম হওয়া এবং ক্লান্তি অনুভূত হওয়া
- চোখের ঝাপসা বা দৃষ্টি অস্পষ্ট লাগা
যাদের বমির সমস্যা হয়, তারা যদি গাড়ির জানালাটা কিছুক্ষণ খোলা রাখেন, তাহলে বাইরের হাওয়ায় স্বস্তিবোধ করবেন।
বমিভাব প্রতিরোধে করণীয়
- 😴 ঘুম বা চোখ বন্ধ রাখা:
বাসে বসে ঘুমিয়ে গেলে বমি আসে না, কারণ চোখ তখন মস্তিষ্কে স্থির থাকার কোনো বিভ্রান্তিমূলক তথ্য দেয় না। ঘুম না এলেও হালকাভাবে দু’চোখ বন্ধ করে রাখুন বা তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব আনুন। - 💺 সঠিক সিট নির্বাচন:
সর্বদা সামনের বা মধ্যবর্তী অংশ বেছে নিন। দৃষ্টিকোণ সামঞ্জস্য রাখুন (যেমন সামনের দিকে তাকানো বা horizon দেখা) পেছনের দোলনাযুক্ত সিট এড়িয়ে চলুন । এই সিট নির্বাচন মোশন সিকনেস কমাতে অত্যন্ত কার্যকর। - 🌳 বাইরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা:
চলন্ত অবস্থায় যানবাহনের ভেতরে দৃষ্টি নিবদ্ধ না রেখে জানালা দিয়ে **বাইরে দূরত্বের দিকে তাকান**। এটি সংকেতের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে সাহায্য করে। - 🪟 আসন নির্বাচন:
এই সমস্যা থেকে বাঁচতে **সামনের দিকে** বা জানালার কাছে আসন নিন। জানালা খুলে দিন, যাতে শরীরে ঠান্ডা বাতাস লাগে। - 📵 পাঠ পরিহার:
চলন্ত গাড়িতে বই, পত্রিকা বা **মোবাইল ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ** করে কোনো কিছু পড়তে থাকলে বমি বমি ভাব বা বমি হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। - ❌ উল্টো দিকে বসা পরিহার:
গাড়িতে যেদিকে চলছে, সেদিকে পেছন দিয়ে অর্থাৎ **উল্টো হয়ে কখনও বসবেন না**। পেছনের সিটেও ঝাঁকি বেশি লাগে, তাই সেটিও এড়িয়ে চলুন। - 🍎 খাদ্যাভ্যাস:
যাদের এই সমস্যা আছে তারা যাত্রা শুরুর আগে **ভরপেট খাবেন না**। হালকা খাবার বা শুধু তরল গ্রহণ করুন। কারন গাড়িতে ওঠার সময় ভরা পেটে খাওয়া বা খালি পেটে থাকা কোনোটাই ঠিক নয়। অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন। - 💊 ওষুধ গ্রহণ:
‘মোশন সিকনেসের জন্য নানা ধরনের ওষুধ রয়েছে। প্রোমেথাজিন থিওক্লেট, প্রোক্লোরপেরাজিন জাতীয় ওষুধ খেলে বমি হবে না।’
চিকিৎসকের পরামর্শমতো বমি ভাব দূর করার জন্য নির্দিষ্ট ওষুধ বাহনে ওঠার **২০-৩০ মিনিট আগেই** খেয়ে নিতে পারেন। কিন্তু, ওষুধ খেলেও অনেক সময় বমি হয়।
সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ হচ্ছে– ওষুধের কাজ করার জন্য অন্তত ৪-৬ ঘণ্টা সময় দিতে হবে। ওষুধ খেয়েই গাড়িতে উঠলেই হবে না। যদি বমি হয়ে যায়, তাহলে আরও একটি ওষুধ খেতে হবে। ঘন ঘন সমস্যা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। - 🍋 প্রাকৃতিক উপায়:
গাড়িতে বসে আদা কিংবা **চুইংগাম চিবালেও** উপকার পাওয়া যায়। এছাড়া, ব্যাগে কয়েকটা লেবু পাতা রাখতে পারেন। গাড়িতে চড়ে তা নাকের কাছে ধরুন। - 🧘 মানসিক প্রস্তুতি: ভ্রমণের সময় ধূমপান করবেন না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, **‘গাড়িতে উঠলেই আমার বমি হবে’**–এমন নেতিবাচক চিন্তা ভ্রমণের সময় কখনও মনে আনা যাবে না। ইতিবাচক থাকুন।
ভ্রমণের আগে কী কী সাবধানতা নেওয়া উচিত?
ভ্রমণের আগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাবধানতা নিলে মোশন সিকনেস বা বমির সমস্যা অনেকটা কমানো যায়। যেমন, হালকা এবং সহজপাচ্য খাবার খাওয়া, পর্যাপ্ত পানি পান করা, পর্যাপ্ত ঘুম থাকা, যাতায়াতের সময় ভারী বা তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা এবং ড্রাইভারের পাশে বা সামনের সিটে বসার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। এছাড়াও ভ্রমণের সময় প্রয়োজনীয় ওষুধ বা মেডিকেল কিট সঙ্গে রাখলে অতিরিক্ত সমস্যা থেকে বাঁচা যায়।
তথ্যসূত্র: মেডিসিন বিশেষজ্ঞ
প্রশ্নোত্তর (FAQ)
১. ভ্রমণে বমি কেন হয়?
মোশন সিকনেস তখন হয় যখন মস্তিষ্ক, চোখ ও ভেতরের কানের মধ্যে সংকেতের অসামঞ্জস্য হয়। গাড়ি, বাস, নৌকা বা বিমানে চোখ যা দেখে, ভেতরের কানের ভারসাম্য যা অনুভব করে, এগুলো মেলেনা—ফলে মাথা ঘোরা, বমি, মাথাব্যথা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
২. মোশন সিকনেস প্রতিরোধের সহজ উপায় কী কী?
- গাড়িতে বসার জন্য সামনে বা ড্রাইভারের পাশে বসা
- জানালা দিয়ে দূরের দৃশ্য দেখা
- হালকা খাবার খাওয়া, খুব ভারী খাবার পরিহার করা
- ভ্রমণের সময় মোবাইল বা বই পড়া কমানো
- প্রয়োজন হলে ডাক্তার পরামর্শক্রমে ওষুধ গ্রহণ
৩. ভ্রমণের সময় বমি এড়ানোর জন্য কোন ওষুধ ব্যবহার করা যায়?
ডাইমেনহাইড্রিনেট (Dimenhydrinate), সাইক্লিজিন (Cyclizine), বা প্রমেথাজিন (Promethazine) জাতীয় ওষুধ মোশন সিকনেস কমাতে সাহায্য করে। তবে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ ব্যবহার না করাই নিরাপদ।
৪. গাড়িতে বা বাসে বমি রোধে কি অন্য কোনো সহজ টিপস আছে?
- গাড়ির চালকের দিকে চোখ রাখা
- হালকা গন্ধযুক্ত খাবার বা আদা চিবানো
- গভীর শ্বাস নেওয়া ও শান্ত থাকা
- শরীরের অবস্থান স্থির রাখা এবং হঠাৎ ঘোরানো এড়িয়ে চলা
৫. বাচ্চাদের ভ্রমণে বমি সমস্যা হলে কি করা উচিত?
- বাচ্চাদের সামনে বা জানালার পাশে বসান
- হালকা খাবার এবং পানি রাখুন
- প্রয়োজন হলে ডাক্তার পরামর্শে বাচ্চাদের জন্য উপযুক্ত ওষুধ ব্যবহার করুন
- ধীরে ধীরে গাড়ির চাকা দেখানোর মাধ্যমে চোখ–মস্তিষ্ক সামঞ্জস্য করান



0 Comments