রাব্বানা আতিনা ফিদ্-দুনিয়া হাসানা - দোয়ার মহত্ত্ব ও তাৎপর্য
রাব্বানা আতিনা ফিদ্-দুনিয়া হাসানা, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আজাবান্নার
নিঃসন্দেহে, রাব্বানা আতিনা ফিদ্-দুনিয়া হাসানা, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আজাবান্নার দোয়াটি ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ দুআগুলোর অন্যতম। এই সংক্ষিপ্ত দোয়ার মাধ্যমে একজন মুসলিম দুনিয়া ও আখিরাতের সব ধরনের কল্যাণ আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, এবং জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে মুক্তি চায়।
এই দোয়ার মহত্ত্ব ও গুরুত্ব
-
এটি শ্রেষ্ঠ ও সর্বব্যাপী দোয়া:
এই দোয়াটি দুনিয়ার জীবন এবং পরকালের জীবনের সব প্রয়োজনকে একত্রে অন্তর্ভুক্ত করে। সাহাবি আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুল (সা.)-এর কাছে সবচেয়ে বেশি পঠিত দোয়া এটিই ছিল। একবার বসরার কিছু লোক আনাস (রা.)-এর কাছে আরও কিছু দোয়ার জন্য অনুরোধ করলে, তিনি তাদের সামনে বারবার এই একই দোয়া পাঠ করেন এবং বলেন, "যদি এই একটি দোয়া কবুল হয়, তবে তোমাদের অন্য যা কিছু প্রয়োজন, সবই এর বরকতে পূরণ হয়ে যাবে"।
-
দুনিয়া ও আখিরাতের ভারসাম্য:
এই দোয়া মুসলিমদের জীবনে দুনিয়া ও আখিরাতের মাঝে এক চমৎকার ভারসাম্য স্থাপন করে। এটি একজন মানুষকে কেবল দুনিয়াদার বা কেবল আখিরাতমুখী হতে নিরুৎসাহিত করে। এর মাধ্যমে আমরা আল্লাহর কাছে উভয় জগতের কল্যাণ চাই।
-
রোগের আরোগ্য লাভ:
হাদিসে এমন একটি ঘটনা বর্ণিত আছে, যেখানে রাসুল (সা.) এক অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে গিয়েছিলেন। সেই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দুনিয়াতেই তার আখিরাতের শাস্তি দিয়ে দেওয়ার জন্য দোয়া করেছিল। এতে সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রাসুল (সা.) তাকে এই দোয়া পাঠ করতে বলেন এবং এর বরকতে সে সুস্থ হয়ে ওঠেছিল।
-
'হাসানা' শব্দের ব্যাপকতা:
এই দোয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো 'হাসানা' শব্দটি, যার অর্থ 'সব ভালো কিছু'। এই 'হাসানা' শব্দের আওতায় যা কিছু আসে:
- দুনিয়ার হাসানা: এর মধ্যে রয়েছে সৎ স্ত্রী বা স্বামী, নেক সন্তান, হালাল রুজি, ব্যবসায় সাফল্য, সুস্থ জীবন, উপকারী জ্ঞান, উত্তম চরিত্র, সম্মান এবং প্রশান্ত মন।
- আখিরাতের হাসানা: এর মধ্যে রয়েছে আল্লাহর ক্ষমা, জাহান্নামের শাস্তি থেকে মুক্তি এবং জান্নাত লাভ।
-
আল্লাহর আজাব থেকে সুরক্ষা:
দোয়ার শেষাংশে "ওয়াকিনা আজাবান্নার" (এবং আমাদের জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষা করো) অংশটি মুসলিমদের মাঝে আল্লাহর শাস্তির ভয় জাগিয়ে তোলে এবং সৎ পথে চলার অনুপ্রেরণা দেয়।
আমাদের জীবনে এই দোয়ার প্রভাব
সার্বক্ষণিক আল্লাহর স্মরণ:
এই দোয়াটি নিয়মিত পাঠ করার মাধ্যমে মানুষ সর্বদা আল্লাহকে স্মরণে রাখতে পারে। এর ফলে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহর উপর ভরসা ও নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়।
জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা:
যখন একজন ব্যক্তি দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতের কল্যাণের জন্য প্রার্থনা করে, তখন তার জীবনের লক্ষ্যগুলো আরও সুনির্দিষ্ট হয়। এটি তাকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী মোহের পরিবর্তে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও অর্থবহ জীবন গঠনে সহায়তা করে।
হতাশা থেকে মুক্তি:
জীবনের উত্থান-পতনে যখন মানুষ হতাশ হয়ে পড়ে, এই দোয়া তাকে ধৈর্য এবং আশার আলো দেখায়। এটি বিশ্বাসীকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সব ভালো কিছু আল্লাহর হাতে এবং তিনি উভয় জগতে উত্তম প্রতিদান দিতে পারেন।
আধ্যাত্মিক উন্নতির সোপান:
এই দোয়া শুধু জাগতিক সাফল্যের জন্য নয়, বরং আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এটি জাহান্নামের ভয় থেকে মুক্ত করে, ঈমানকে শক্তিশালী করে এবং মানুষকে আল্লাহর আনুগত্যের পথে দৃঢ় রাখে।
দোয়া কবুলের নিশ্চয়তা:
যেহেতু এটি স্বয়ং কুরআনুল কারিমের একটি আয়াত এবং রাসুল (সা.)-এর সবচেয়ে প্রিয় দোয়াগুলোর একটি, তাই এর বরকতে দোয়া কবুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এই দোয়া পড়া মানে আল্লাহর কাছে এমন এক আবেদন, যা স্বয়ং আল্লাহ তাঁর পবিত্র গ্রন্থে শিখিয়ে দিয়েছেন।
হজ ও ওমরাহর সুন্নত:
কাবাঘরের তাওয়াফের সময় রুকনে ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে এই দোয়া পড়া সুন্নত। এর মাধ্যমে হাজিরা দুনিয়া ও আখিরাতের সমস্ত কল্যাণ কামনা করেন।
উপসংহার: 'রাব্বানা আতিনা ফিদ্-দুনিয়া হাসানা...' দোয়াটি কেবল কিছু শব্দ নয়, বরং একজন মুসলিমের জীবনের একটি সম্পূর্ণ রূপরেখা। এটি আমাদেরকে শেখায় যে, জীবনের উদ্দেশ্য কেবল দুনিয়ার ভোগ-বিলাস নয়, বরং এর পাশাপাশি আখিরাতের চিরস্থায়ী সুখের জন্যও চেষ্টা করা। এই দোয়ার নিয়মিত আমল একজন বিশ্বাসীকে কেবল পরকালে নয়, বরং এই দুনিয়ার জীবনেও শান্তি, কল্যাণ এবং সাফল্যের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়।



0 Comments