ঘুমানোর আগে সূরা মুলক পড়ার ফজিলত ও উপকারিতা
📚 নিশ্চয়ই প্রতিটি রাত্রি ঘুমের পূর্বে কিছু আমল আমাদের জীবনে অসাধারণ কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তন্মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ আমল হলো – সূরা আল-মুলক পাঠ করা। এটি এমন একটি সূরা, যা কবরের আজাব থেকে রক্ষা করে, কিয়ামতের দিন সুপারিশ করে এবং মুমিন বান্দার জন্য সুরক্ষা দেয়ার প্রতিশ্রুতি রাখে।
📖 হাদীসের আলোকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে প্রতিরাতে এই সূরাটি পাঠ করতেন এবং উম্মতকে তা পাঠের প্রতি উৎসাহিত করতেন। তাই বলা যায়, রাতের অন্ধকারে (🔹অন্ধকারে= রাত্রিকাল, ঘুমানোর আগে সময়, অথবা মানসিক বা আধ্যাত্মিক অন্ধকার (পাপ, চিন্তা-চাপা, শয়তানের প্ররোচনা ইত্যাদি)। ) এই নূরانی ( 🔹 নূরানী সূরা = "নূর" মানে আলো। অর্থাৎ, সূরা মুলক হচ্ছে একটি আলোকিত, পবিত্র ও হেদায়াতদাতা সূরা। ) সূরার তিলাওয়াত একজন মুসলিমের জীবনে হতে পারে অফুরন্ত নাজাত ও বরকতের চাবিকাঠি।
🔖 রাত্রির অন্ধকারে যখন চারপাশে নীরবতা এবং নিঃসঙ্গতা, তখন সূরা মুলক তিলাওয়াত করলে এটি মানুষের মন ও আত্মাকে আলোয় উদ্ভাসিত করে, ভয় ও আজাব থেকে নিরাপত্তা দেয়, কিয়ামতের দিন সুপারিশ করে— এটাই "নূরানি" বলা হয়েছে।
সুরা মুলক পবিত্র কোরআনের ৬৭তম সূরা। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে। সূরাটির রয়েছে ২টি রুকু, ৩০টি আয়াত। এর শুরুতেই আল্লাহ ঘোষণা করেছেন তাঁর সর্বময় সার্বভৌম কর্তৃত্ব। সূরার আরবি শব্দ ‘মুলক’ মানে হলো ‘সার্বভৌমত্ব’। আর
রাতে ঘুমানোর আগে সূরা আল-মুলক তিলাওয়াত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়,
এই সূরাটি কিয়ামতের দিন পাঠকারীর পক্ষ থেকে সুপারিশ করবে এবং তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবে।
এটি শুধু আখিরাতের নিরাপত্তার মাধ্যমই নয়, বরং আল্লাহর রহমত ও বরকত লাভেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল।
🕋 হজরত উসমান (রা.) ও কবরের বাস্তবতা
হজরত উসমান (রা.) যখন কবরের পাশ দিয়ে যেতেন, তখন তিনি এতটাই কাঁদতেন যে তার দাড়ি ও বুক ভিজে যেত। লোকেরা জিজ্ঞেস করতঃ “আপনি জান্নাত ও জাহান্নামের বর্ণনা শুনেও এতটা কাঁদেন না, কিন্তু কবরের পাশে এসে এত কাঁদেন কেন?”
তিনি বলতেন: “আমি রাসুল (সা.) এর কাছ থেকে শুনেছি, কবর হল আখিরাতের প্রথম ঘাঁটি। যে ব্যক্তি এখানে মুক্তি পাবে, তার জন্য পরবর্তী ধাপগুলো সহজ হবে। আর যে এখানে মুক্তি পাবে না, তার জন্য পরবর্তী ধাপগুলো হবে আরও কঠিন ও ভয়ানক।”
📖 সূরা মুলক ও কবরের আজাব থেকে মুক্তি
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন: “প্রতিদিন এশার নামাজের পর রাতে ঘুমানোর আগে যে ব্যক্তি ‘সূরা তাবারাকাল্লাজি’ অর্থাৎ সূরা মুলক তিলাওয়াত করবে, তার মৃত্যুর পর আল্লাহ তার কবরের শাস্তি মাফ করে দেবেন।”
📚 হাদিস থেকে আরও জানা যায়:
হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন:
“কোরআনে এমন একটি সূরা আছে যার আয়াত সংখ্যা ৩০টি। এই সূরা তিলাওয়াতকারীকে ক্ষমা না করে ছাড়বে না। সূরাটি হলো ‘তাবারাকাল্লাজি বি ইয়াদিহিল মুলক’।” — (তিরমিজি, ২৮৯১)
📝 সূরা মুলক এর শিক্ষা:
- কবর হলো আখিরাতের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-স্থল।
- প্রতিদিন রাতে সূরা মুলক তিলাওয়াত করলে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
- এটি কেবল তিলাওয়াত নয়, বরং আত্মা ও বিশ্বাসকে আল্লাহর সার্বভৌমত্বে শির নত করার আমল।
🕋 সূরা মুলকের বিষয়বস্তু
সুরাটি আল্লাহর সৃষ্টি, সার্বভৌমত্ব, আখিরাতের শাস্তি ও প্রতিদান, এবং মানুষের দায়িত্বশীলতার উপর গুরুত্ব দেয়। সূরাটির প্রতিটি আয়াতে একটি দিক ফুটে উঠেছে:
- ১–৪ আয়াত: আল্লাহর সৃষ্টির নিখুঁত সৌন্দর্য
- ৫–১৫ আয়াত: জাহান্নাম ও জান্নাতের বিবরণ
- ১৬–২২ আয়াত: হঠাৎ বিপদের সতর্কবার্তা
- ২৩–২৪ আয়াত: সেই বিপদে প্রস্তুতির আহ্বান
- ২৫–২৭ আয়াত: মানুষ বিপদের সময় জানতে চায়
- ২৮–৩০ আয়াত: আল্লাহর শক্তি ও মানুষের দুর্বলতা
📖 সূরা মুলকের ফজিলত
এ সুরা পাঠের ফজিলত সীমাহীন। এটি কবরের আজাব থেকে রক্ষা করে, এবং প্রতিদিন রাতে এটি তিলাওয়াত করা সুন্নত হিসেবে প্রমাণিত।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন কবরস্থিত ব্যক্তির কাছে পায়ের দিক দিয়ে ফেরেশতারা শাস্তির জন্য আসতে চাইবে। তখন তার পদদ্বয় বলবে আমার দিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা সে সুরা মুলক পাঠ করত। তখন তার সিনা অথবা পেটের দিক দিয়ে আসতে চাইবে। তখন সিনা অথবা পেট বলবে আমার দিকে দিয়ে আসার কোনো রাস্তা তোমাদের জন্য নেই। কেননা সে আমার মধ্যে সুরা মুলক ভালোভাবে ধারণ করে রেখেছিল। তারপর তার মাথার দিক দিয়ে আসার চেষ্টা করবে। মাথা বলবে এদিক দিয়ে আসার রাস্তা নেই। কেননা সে আমার দ্বারা সুরা মুলক পাঠ করেছিল।
🌙 Surah Mulk কখন ও কিভাবে পড়বেন?
- প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে পড়া উত্তম।
- নামাজের পরে বা ঘুমানোর আগে পড়লে বেশি ফজিলত পাওয়া যায়।
- মুখস্থ না থাকলে দেখে দেখে অর্থসহ বুঝে পড়লেও সওয়াব পাওয়া যাবে।
- তবে এর মানে এই নয় যে সুরাটি দিনে পড়া যাবে না। এটি যে কোনো সময় পড়া যাবে। তবে বিশেষত রাতে এ সুরা পড়া উত্তম।
🔍 Surah Mulk এর আয়াত বিশ্লেষণ ও শিক্ষণীয় বিষয়
আল্লাহ মানুষের বুদ্ধি ও দৃষ্টি দিয়ে সৃষ্টি বিশ্লেষণ করতে বলেন। “আবার তাকাও, কোনো ত্রুটি দেখতে পাও কি না। তারপর তুমি বারবার তাকাও, তোমার দৃষ্টি ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে।” – এ আয়াতে আল্লাহর নিখুঁত সৃষ্টির প্রতি গভীর দৃষ্টি দেওয়ার আহ্বান করা হয়েছে।
আল্লাহর সৃষ্টিতে কোমলতা ও কঠোরতা একত্রে রয়েছে। যেমন, তিনি আকাশকে তারকায় সুশোভিত করেছেন, আবার তা করেছেন শয়তান প্রতিহত করার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র।
📌 উপসংহার
অবশেষে বলা যায়, সূরা আল-মুলক শুধুই একটি সূরা নয়— এটি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং আখিরাত সম্পর্কে গভীরভাবে জানার একটি চাবিকাঠি। প্রতিদিন রাতে এটি পাঠের মাধ্যমে একজন মুমিন তার জীবনে আল্লাহর নৈকট্য ও রক্ষা লাভ করতে পারে। আর এটি একজন মুসলিমের রাতের নিরাপত্তা, কবরের আলোকবর্তিকা এবং পরকালের সুপারিশকারী। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে মাত্র কয়েক মিনিট সময় দিয়ে যদি আমরা এই বরকতময় সূরাটি পাঠ করি, তবে তা আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত উভয় জগতেই অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনবে। আসুন, আমরা আজ থেকেই এই নূরানী অভ্যাসটি নিজেদের জীবনের অংশ করে নেই এবং প্রিয়জনদেরও এর ফজিলতের কথা জানিয়ে আমল করতে উৎসাহিত করি। আল্লাহ আমাদের সকলকে কুরআনের আলোয় আলোকিত জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। 🤲📖
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আমার একান্ত ইচ্ছা যে এই সুরাটি আমার প্রত্যেক উম্মতের অন্তরে গেঁথে থাকুক।
আসুন আমরা সবাই প্রতিদিন সুরা মুলক পাঠ করে নিজেদের রুহানিয়াত বৃদ্ধি করি ও আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করি। 🌙
❓ প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQ)
❓ ঘুমানোর আগে সূরা মুলক কেন পড়া উচিত?
হাদিস অনুযায়ী সূরা মুলক কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা করে এবং রাতের ঘুমের আগে এটি পাঠ করা রাসুল (সা.)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল ছিল। এটি আখিরাতে শাফায়াত করে এবং শান্তি প্রদান করে।
❓ সূরা মুলক কোন সময় পড়া উত্তম?
রাতে ঘুমানোর আগে সূরা মুলক পড়া সবচেয়ে উত্তম। তবে চাইলে যেকোনো সময় এটি পড়া যাবে, কারণ কুরআন তিলাওয়াত সব সময়ই বরকতময়।
❓ সূরা মুলক মুখস্থ না থাকলে কি দেখে দেখে পড়া যাবে?
জি হ্যাঁ, মুখস্থ না থাকলে দেখে দেখে অর্থসহ তিলাওয়াত করলেও সওয়াব পাওয়া যায়। বরং অর্থ বুঝে পড়লে ইমান আরও মজবুত হয়।
❓ সূরা মুলক কত আয়াত ও রুকু রয়েছে?
সূরা মুলক পবিত্র কোরআনের ৬৭তম সূরা। এতে রয়েছে ৩০টি আয়াত এবং ২টি রুকু। এটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।
❓ সূরা মুলক তিলাওয়াত করলে কী উপকার হয়?
সূরা মুলক তিলাওয়াত করলে কবরের শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, রাতের নিরাপত্তা ও মানসিক শান্তি অর্জিত হয় এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন হয়।
0 Comments